বাংলাদেশে জমির মালিকানা যাচাই, কেনা-বেচা, নামজারি বা খারিজ– সবকিছুর মূল ভিত্তি হলো খতিয়ান। তাই খতিয়ান কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি, তা জানা প্রতিটি জমির মালিক, ক্রেতা ও সাধারণ নাগরিকের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
খতিয়ানে জমির সঠিক মালিক, দাগ নম্বর, পরিমাণ, অবস্থান ও শ্রেণি সম্পর্কে পরিষ্কার সরকারি তথ্য থাকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জরিপের মাধ্যমে তৈরি হওয়ায় খতিয়ানের একাধিক ধরন রয়েছে। কোন খতিয়ান সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং কোনটি বর্তমানে প্রচলিত- এসব বিষয় জানলে জমি সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।
খতিয়ান কাকে বলে?
খতিয়ান হলো জমির মালিকানা ও অবস্থান সম্পর্কিত সরকারি নথি, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট মৌজার অধীনে একজন ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তির জমির রেকর্ড সংরক্ষিত থাকে। সহজ কথায়, খতিয়ান হলো জমির পরিচয়পত্র। এটি জমি সংক্রান্ত তথ্যের সবচেয়ে প্রামাণিক দলিলগুলির মধ্যে অন্যতম।
এতে উল্লেখ থাকে-
জমির মালিকের নাম
জমির পরিমাণ (একর/শতক/গণ্ডা/কাঠা)
দাগ নম্বর
মৌজার নাম
জমির শ্রেণি (বসতবাড়ি, কৃষি, জলাশয় ইত্যাদি)
রেকর্ড তৈরির সাল
সংশ্লিষ্ট নোট বা মন্তব্য
খতিয়ান কত প্রকার ও কি কি ? খতিয়ানের প্রকারভেদ
বাংলাদেশে বর্তমান ও অতীতের বিভিন্ন জরিপের ভিত্তিতে মোট ৫ ধরনের খতিয়ান রয়েছে।
সেগুলো হলো-
CS খতিয়ান (Cadastral Survey)
RS খতিয়ান (Revisional Survey)
BS খতিয়ান (Bangladesh Survey)
SA খতিয়ান (State Acquisition Survey)
DSP/Mutation খতিয়ান (নামজারি বা খারিজ খতিয়ান)
১. CS খতিয়ান (Cadastral Survey) কি?
CS খতিয়ান হলো ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা জমির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জরিপ। 1888–1940 সালের মধ্যে এই রেকর্ড তৈরি হয়।
CS খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য
এটি সবচেয়ে প্রাচীন এবং অধিক নির্ভরযোগ্য রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত।
জমির দাগ নম্বর ও সীমানা অনেক পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকে।
প্রায়ই বর্তমান রেকর্ডের সঙ্গে প্রাচীন CS খতিয়ান তুলনা করে জমির অবস্থান নিশ্চিত করা হয়।
CS খতিয়ান কেন এখনো গুরুত্বপূর্ণ?
যদিও জমির মালিকানা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়েছে, তবুও CS খতিয়ানের ভিত্তিতে পরবর্তী সব রেকর্ড তৈরি হয়েছে। কোনো বিরোধ বা অসঙ্গতি দেখা দিলে আদালতেও এটি অধিক গুরুত্ব পায়।
২. SA খতিয়ান – State Acquisition Survey
পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর (১৯৫০ সালের জমিদারি উচ্ছেদ আইন) তৈরি করা হয় SA খতিয়ান।
SA খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য
জমিদারদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণের পর নতুন রেকর্ড প্রস্তুত করা হয়।
জমির মালিকানার বড় পরিবর্তন এই জরিপে প্রতিফলিত হয়।
SA খতিয়ান অনেক এলাকায় সম্পূর্ণ হলেও কিছু জায়গায় আংশিক পাওয়া যায়।
SA খতিয়ানের গুরুত্ব
বর্তমান মালিকানার শিকড় খুঁজতে SA রেকর্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।
৩. RS খতিয়ান – Revisional Survey
সাধারণভাবে CS এবং SA খতিয়ানের ভিত্তিতে ত্রুটি সংশোধন ও পরিবর্তন প্রতিফলিত করে তৈরি করা হয় RS খতিয়ান। এটি অনেক এলাকায় 1960–1990 সালের মধ্যে প্রস্তুত হয়।
RS খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য
অনেক এলাকায় RS হলো সর্বশেষ পূর্ণ জরিপ রেকর্ড।
পরে জমির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে এমন বিষয়গুলো প্রতিফলিত থাকে।
RS খতিয়ান আদালতেও শক্ত প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত।
RS খতিয়ান কেন প্রয়োজন হয়?
CS বা SA তে ভুল দাগ/পরিমাণ ঠিক করতে এবং বর্তমান মালিকানা অনুযায়ী আপডেট করার জন্য RS জরিপ করা হয়।
৪. BS খতিয়ান – Bangladesh Survey (সর্বশেষ রেকর্ড)
বাংলাদেশ সরকার আরও হালনাগাদ ও ডিজিটাল রেকর্ড তৈরির জন্য BS খতিয়ান প্রবর্তন করে। অনেক এলাকায় এটি চলমান, অনেক জায়গায় শেষ হয়েছে।
BS খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য
এটি ডিজিটাল ভিত্তিক সম্পূর্ণ নতুন রেকর্ড।
দাগ, মালিকানা, জমির ক্লাসিফিকেশন- সব তথ্য আপডেট থাকে।
ভবিষ্যতে দেশের সব জমির চূড়ান্ত রেকর্ড হবে BS খতিয়ান।
BS খতিয়ানের গুরুত্ব
অনলাইন জমির তথ্য যাচাইয়ের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস।
ভুল সংশোধন, অনিয়ম দূরীকরণ ও আধুনিক ডেটা ইনপুট রয়েছে।
৫. নামজারি/খারিজ খতিয়ান (Mutation Khatiyan / DSP Khatiyan)
জমি কেনা-বেচা, উত্তরাধিকার বা অন্যান্য কারণে মালিকানা পরিবর্তন হলে নতুন মালিকের নামে খতিয়ান তৈরি করা হয়- এটাই নামজারি বা খারিজ খতিয়ান।
Mutation খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য
এতে শুধুমাত্র নতুন মালিকানা তথ্য সংশোধন করা হয়।
পুরনো দাগ, জমির পরিমাণ, অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে।
নামজারির মাধ্যমে ভূমি অফিসের খতিয়ান আপডেট হয়।
Mutation খতিয়ান কেন জরুরি?
যদি আপনি জমি কিনে থাকেন, কিন্তু নামজারি না করেন- তাহলে আইনের চোখে আপনি এখনো জমির মালিক নন। তাই জমির সব ধরনের লেনদেন ও কর পরিশোধের জন্য mutation অপরিহার্য।
কোন খতিয়ান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
প্রশ্ন আসে RS, CS, SA, BS এর মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? আসলে সব খতিয়ানই নিজ নিজ সময়ের রেকর্ড।
তবে সাধারণভাবে-
BS খতিয়ান → সর্বশেষ ডিজিটাল রেকর্ড
RS খতিয়ান → বর্তমানে অধিকাংশ জমির প্রচলিত রেকর্ড
CS খতিয়ান → ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য
জমি কেনার আগে তিনটি রেকর্ড (CS+RS+BS) দেখে মিলিয়ে নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ।
অনলাইনে খতিয়ান কিভাবে দেখবেন?
আপনি land.gov.bd বা eporcha.gov.bd এর মাধ্যমে যেকোনো সময় অনলাইনে খতিয়ান/পর্চা দেখতে এবং অনুলিপি ডাউনলোড করতে পারেন।
অনলাইনে খতিয়ান দেখতে যা লাগবে-
জেলা
উপজেলা
মৌজা
খতিয়ান নম্বর
দাগ নম্বর (যদি থাকে)
উপসংহার
বাংলাদেশে সঠিক জমি মালিকানা যাচাইয়ের জন্য খতিয়ানই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সরকারি নথি। তাই খতিয়ান কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি– এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
CS, SA, RS, BS এবং নামজারি খতিয়ান- প্রতিটি রেকর্ডই জমির ভিন্ন সময়ের ইতিহাস তুলে ধরে। জমি কেনা-বেচা, উত্তরাধিকার, খারিজ বা বিরোধ নিষ্পত্তি- যে কাজই হোক, সঠিক খতিয়ান মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য।
সঠিক তথ্য জেনে সচেতন সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতের আইনি জটিলতা এড়ানো সম্ভব, এবং জমি সংক্রান্ত প্রতিটি কাজ হয়ে ওঠে নিরাপদ ও স্বচ্ছ।


