বাংলাদেশে সময় অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ভূমি জরিপ পরিচালিত হয়েছে, যার মধ্যে সিএস (CS), এসএ (SA), আরএস (RS), বিএস (BS) বা বিআরএস (BRS) এবং সর্বশেষ সিটি জরিপ (City Survey) অন্যতম। এই প্রবন্ধে আমরা সিটি জরিপ খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব, এর মাধ্যমে জমি চেনার উপায় এবং এটি সংগ্রহ করার পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সিটি জরিপ খতিয়ান কী?
সাধারণভাবে, ভূমি জরিপ বিভাগ কর্তৃক সরেজমিনে জমিতে গিয়ে জমির মালিকানা, সীমানা, পরিমাণ ও অন্যান্য বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যে রেকর্ড প্রকাশ করা হয়, তাকে খতিয়ান বলে।
সিটি জরিপের সংজ্ঞা
সিটি জরিপ (City Survey) হলো মূলত ঢাকা মহানগর জরিপ-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। আর.এস. (Revisional Survey) বা বিএস (Bangladesh Survey)-এর পর ঢাকা মহানগরীর অভ্যন্তরে এবং কিছু ক্ষেত্রে এর সংলগ্ন এলাকার ভূমির সর্বশেষ অবস্থা, প্রকৃতি, মালিক, দখলদার ইত্যাদি হালনাগাদ করার লক্ষ্যে এই জরিপ পরিচালিত হয়।
সময়কাল: এটি মূলত ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। কোথাও কোথাও এটিকে বিএস (BS) জরিপের অন্তর্ভুক্ত বা পরবর্তী ধাপ হিসেবেও গণ্য করা হয়।
উদ্দেশ্য: ঢাকা মহানগরীর দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূমি ব্যবহারের ধরন ও জমির সঠিক মালিকানা নিশ্চিত করা, এবং পূর্ববর্তী জরিপগুলোর (বিশেষ করে এস.এ. জরিপ) ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা।
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য: এটি দেশের সবচেয়ে আধুনিক জরিপগুলির মধ্যে একটি এবং এর রেকর্ডগুলো হাতে লেখা নয়, বরং সম্পূর্ণ কম্পিউটার টাইপকৃত ও প্রিন্ট করা হয়।
কেন এই জরিপকে ‘সিটি’ বলা হয়?
এই জরিপটি বিশেষভাবে ঢাকা মহানগরীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং দ্রুত বর্ধনশীল শহুরে এলাকার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই ধরনের শহুরে এলাকায় জমির মূল্য অনেক বেশি এবং মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতাও বেশি থাকে। তাই এটিকে অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলের জরিপ থেকে আলাদা করে “সিটি জরিপ” বা “ঢাকা মহানগর জরিপ” নাম দেওয়া হয়।
সিটি জরিপ খতিয়ানের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য
সিটি জরিপ খতিয়ান, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার জন্য, অত্যন্ত মূল্যবান।
প্রধান গুরুত্বসমূহ:
সর্বশেষ রেকর্ড: এটি যেহেতু ঢাকা মহানগরীর সর্বশেষ প্রকাশিত খতিয়ান, তাই আইনি ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা সর্বোচ্চ। জমি কেনা-বেচা, ঋণ গ্রহণ, এবং নামজারি (মিউটেশন) করার সময় এই খতিয়ান সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।
ত্রুটিমুক্ত রেকর্ড: এই জরিপে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে পূর্ববর্তী জরিপগুলির (যেমন এসএ জরিপ) তুলনায় এতে ত্রুটি-বিচ্যুতির পরিমাণ অনেক কম।
কম্পিউটারাইজড: এটি সম্পূর্ণরূপে কম্পিউটার টাইপকৃত ও মুদ্রিত হওয়ায় পাঠোদ্ধার করা সহজ এবং হস্তলিখিত ত্রুটির ঝুঁকি নেই।
আইনি প্রমাণ: ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ বা মামলায় সিটি জরিপ খতিয়ান জমির বর্তমান ও সঠিক মালিকানা প্রমাণের জন্য একটি শক্তিশালী দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: শহুরে এলাকার সঠিক ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে এই রেকর্ড সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সিটি জরিপ খতিয়ান চেনার উপায়:
অন্যান্য খতিয়ান থেকে সিটি জরিপ খতিয়ানকে সহজে চেনার জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
আকৃতি: এই খতিয়ানটি সাধারণত আড়াআড়িভাবে (Horizontal) মুদ্রিত হয়, যা সিএস বা আরএস খতিয়ানের উলম্ব (Vertical) আকৃতি থেকে ভিন্ন।
মুদ্রণ: খতিয়ানটি হাতে লেখা নয়, বরং কম্পিউটারে টাইপ করা ও প্রিন্ট করা হয়।
শিরোনাম: খতিয়ানের উপরে “ঢাকা মহানগর জরিপ” বা “সিটি জরিপ” কথাটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে।
আধুনিকতা: এতে মালিকের নাম, দাগ নম্বর, জমির শ্রেণি এবং পরিমাণ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে এবং আধুনিক পদ্ধতিতে বিন্যস্ত থাকে।
সিটি জরিপ খতিয়ান সংগ্রহ ও যাচাইয়ের পদ্ধতি
সিটি জরিপ খতিয়ান যেহেতু সর্বশেষ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই এটি সংগ্রহ ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়া জানা আবশ্যক।
সরাসরি রেকর্ড রুম থেকে সংগ্রহ (সার্টিফাইড কপি)
খতিয়ানের আইনি বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।
স্থান: সাধারণত ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের অধীনে সংশ্লিষ্ট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের রেকর্ড রুম থেকে এই খতিয়ানের চূড়ান্ত প্রকাশনা সম্পন্ন হয়। এরপর এটি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের (DC) রেকর্ড রুমে হস্তান্তর করা হয়।
আবেদন: জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম থেকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আবেদন ফরম পূরণ করতে হয়।
প্রয়োজনীয় তথ্য: আবেদনের জন্য মৌজা, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, এবং আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য প্রয়োজন।
প্রমাণ: প্রাপ্ত খতিয়ানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সীল ও স্বাক্ষর থাকে, যা এটির আইনি বৈধতা নিশ্চিত করে।
অনলাইনে খতিয়ান অনুসন্ধান ও ডাউনলোড
ডিজিটাল ভূমিসেবার কল্যাণে এখন অনলাইনেও খতিয়ানের তথ্য অনুসন্ধান এবং সার্টিফাইড কপির জন্য আবেদন করা যায়।
ওয়েবসাইট: ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত ওয়েবসাইট (যেমন- www.land.gov.bd বা eporcha.gov.bd) ব্যবহার করতে হবে।
অনুসন্ধান: ওয়েবসাইটে “খতিয়ান অনুসন্ধান” অপশনে গিয়ে আপনার বিভাগ, জেলা, উপজেলা/থানা, মৌজা, এবং খতিয়ানের ধরন (সিটি জরিপ) নির্বাচন করতে হবে।
তথ্য প্রদান: খতিয়ান নম্বর বা দাগ নম্বর দিয়ে অনুসন্ধান করলে খতিয়ানের খসড়া তথ্য দেখতে পাওয়া যেতে পারে।
সার্টিফাইড কপির আবেদন: খসড়া যাচাইয়ের পর যদি সার্টিফাইড কপি বা পর্চার প্রয়োজন হয়, তবে অনলাইনে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে আবেদন করা যায়। আবেদন মঞ্জুর হলে তা ডাকযোগে বা সরাসরি রেকর্ড রুম থেকে সংগ্রহ করা যায়।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: অনলাইনে প্রদর্শিত খসড়া তথ্য শুধুমাত্র যাচাইয়ের জন্য ব্যবহার করা উচিত। আইনি কাজে ব্যবহারের জন্য সর্বদা জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম থেকে সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করা আবশ্যক।
মালিকানা যাচাইয়ের পদ্ধতি
জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে হলে সিটি জরিপ খতিয়ানের সঙ্গে পূর্ববর্তী খতিয়ান (যেমন- আরএস, এসএ বা সিএস) এবং ক্রয়কৃত দলিলের তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে।
ক্রমিক মালিকানা: নিশ্চিত করতে হবে যে পূর্ববর্তী রেকর্ডের মালিকানা থেকে বর্তমান সিটি জরিপ খতিয়ানের মালিকানা পর্যন্ত জমিটি বৈধ দলিল ও নামজারির (মিউটেশন) মাধ্যমে এসেছে।
দাগ ও পরিমাণ: দাখিলা এবং দলিল অনুযায়ী খতিয়ানে উল্লিখিত দাগ নম্বর ও জমির পরিমাণ ঠিক আছে কিনা, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা উচিত।
সিটি জরিপ এবং অন্যান্য জরিপের সম্পর্ক
সিটি জরিপ অন্য জরিপগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এটি নিজস্ব গুরুত্ব বহন করে:
জরিপের নামসময়কালপ্রধান বৈশিষ্ট্যসিএস (CS)১৮৮৯-১৯৪০ (প্রথম)
উপমহাদেশের প্রথম জরিপ, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মৌলিক রেকর্ড।এসএ (SA)১৯৫০-এর দশকেজমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর দ্রুত প্রণীত, ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা বেশি।আরএস (RS)১৯৫০ সালের পরএসএ-এর ত্রুটি দূর করার জন্য প্রণীত সংশোধনীমূলক জরিপ
বিএস/বিআরএস (BS/BRS)চলমানসর্বশেষ আধুনিক জরিপ, যা আরএস-এর ভুল সংশোধনের কাজ করছে।সিটি জরিপ (City Survey)১৯৯৯-২০০০ (ঢাকা মহানগর)ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত আধুনিক, কম্পিউটারাইজড ও সর্বশেষ রেকর্ড।
আইনি ভিত্তি:
ভূমি সংক্রান্ত যেকোনো বিরোধে, সিএস খতিয়ানকে সবচেয়ে পুরোনো এবং মৌলিক রেকর্ড হিসেবে ধরা হয়। তবে সিটি জরিপ যেহেতু সর্বশেষ জরিপ এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি, তাই ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে এর তথ্যই বর্তমান মালিকানা প্রমাণের জন্য প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যদি সিটি জরিপে কোনো ত্রুটি থাকে, তবে পূর্ববর্তী জরিপগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে তা সংশোধনের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়।
উপসংহার
সিটি জরিপ খতিয়ান হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি আধুনিক ও অপরিহার্য দলিল। এই খতিয়ানের সঠিকতা ও এর আইনি গুরুত্বের কারণে জমির মালিকদের অবশ্যই এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখা উচিত।
আপনার ঢাকা মহানগরীর কোনো সম্পত্তি থাকলে, নিশ্চিত করুন যে আপনার নামে হালনাগাদ সিটি জরিপ খতিয়ান আছে এবং তা বৈধ দলিলের মাধ্যমে আপনার মালিকানা প্রমাণ করে।


