বাংলাদেশে জমি কেনা-বেচা বা উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা পেতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো জমি খারিজ করার পদ্ধতি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা। অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করার পর খারিজ না করেই নিশ্চিন্ত থাকেন, কিন্তু এটি একটি বড় ভুল।
খারিজের মাধ্যমে সরকারিভাবে নতুন মালিকের নামে রেকর্ড তৈরি হয়, যা আইনগত স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতের বিরোধ বা প্রতারণা থেকে রক্ষা করে। তাই জমি ক্রয়ের পর যত দ্রুত সম্ভব অনলাইন বা অফলাইন প্রক্রিয়ায় জমি খারিজ করা অত্যন্ত জরুরি।
জমি খারিজ (Mutation of Land) কী?
জমি খারিজ বা নামজারি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জমির নতুন মালিকের নাম সরকারিভাবে রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জমি কেনা-বেচা, হেবা, দান বা উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা পরিবর্তনের পরে এই নামজারি বাধ্যতামূলক। এটি ভূমি রেকর্ডে (খতিয়ান) মালিকের নাম পরিবর্তন করে নতুন মালিককে আইনি স্বীকৃতি দেয়।
জমি খারিজ করার নিয়ম ও প্রক্রিয়া/পদ্ধতি:
জমি খারিজের প্রক্রিয়াটি মূলত পাঁচটি ধাপে সম্পন্ন হয়– আবেদন জমা, নোটিশ জারি, তদন্ত, শুনানি, এবং চূড়ান্ত অনুমোদন।
নিচে প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:
ক) আবেদন জমা (Application Submission):
কোথায় আবেদন করবেন: জমি খারিজের আবেদন করা যায়-
- সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে সরাসরি গিয়ে, অথবা
- অনলাইনে নামজারি পোর্টাল (https://land.gov.bd) ব্যবহার করে।
অনলাইন আবেদনের ধাপসমূহ:
1️⃣ https://land.gov.bd ওয়েবসাইটে যান।
2️⃣ “নামজারি আবেদন করুন” অপশনে ক্লিক করুন।
3️⃣ আবেদনকারীর তথ্য, জমির দলিল নম্বর, মৌজা, দাগ, খতিয়ান ইত্যাদি পূরণ করুন।
4️⃣ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (দলিল, খাজনার রসিদ, এনআইডি ইত্যাদি) স্ক্যান করে আপলোড করুন।
5️⃣ নির্ধারিত নামজারি ফি অনলাইনে পরিশোধ করুন (বিকাশ, নগদ বা রকেটের মাধ্যমে)।
6️⃣ আবেদন জমা দিন এবং প্রাপ্ত ট্র্যাকিং নম্বর সংরক্ষণ করুন।
খ) নোটিশ জারি (Notice):
আবেদন জমা দেওয়ার পর ভূমি অফিস থেকে বিরোধী পক্ষ বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নোটিশ প্রদান করা হয়। এই নোটিশে বলা থাকে- নির্দিষ্ট জমির খারিজ আবেদন দাখিল হয়েছে, যদি কোনো আপত্তি থাকে তবে নির্ধারিত সময়ে জানাতে হবে।
গ) তদন্ত (Investigation):
ক্ষেত্রবিশেষে তহসিলদার বা ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সরেজমিনে গিয়ে জমির অবস্থা, দখল, ও সীমা পর্যালোচনা করেন। তদন্তের রিপোর্টে আবেদনকারীর দাবির সত্যতা যাচাই করা হয় এবং সেটি এসিল্যান্ডের কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়।
ঘ) শুনানি (Hearing):
শুনানির দিন আবেদনকারী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষদের উপস্থিত থাকতে হয়। এসিল্যান্ড (AC Land) আবেদনকারীর বক্তব্য ও নথি যাচাই করে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন। যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আবেদন অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়।
ঙ) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও খতিয়ান প্রস্তুত:
শুনানির পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবেদন যাচাই করে অনুমোদন দেন। অনুমোদনের পর-
- নতুন খতিয়ান প্রস্তুত করা হয়।
- আবেদনকারীকে নামজারি সার্টিফিকেট (দাখিলা) প্রদান করা হয়।
জমি খারিজ না করলে কী হয়?
বাংলাদেশে জমি কেনা-বেচা বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার পর খারিজ (নামজারি) করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রক্রিয়া। অনেকেই জমি ক্রয় করার পর খারিজ না করেই ব্যবহার করতে থাকেন, যা পরবর্তীতে বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন চলুন
জমি খারিজ না করলে নিচের সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে:
১. মালিকানা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না
জমি ক্রয়ের পর রেজিস্ট্রেশন করলেই কেবল মালিকানা সম্পূর্ণ হয় না। খারিজ (নামজারি) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারিভাবে আপনার নামে রেকর্ড তৈরি হয়। যদি খারিজ না করা হয়, তাহলে সরকারিভাবে জমির মালিকানা এখনও আগের মালিকের নামে থেকে যায়।
ফলে:
- আপনি আইনগতভাবে মালিক হিসেবে গণ্য হবেন না।
- ভবিষ্যতে কোনো মামলা-মোকদ্দমায় আপনার পক্ষে প্রমাণ দেওয়া কঠিন হবে।
২. জমির খাজনা পরিশোধে সমস্যা হবে
খারিজ না থাকলে আপনার নামে ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) নির্ধারিত হবে না।
ফলে:
- আপনি নিজের নামে খাজনা দিতে পারবেন না।
- খাজনা পরিশোধ না হলে জমির মালিকানা নিয়ে ভবিষ্যতে বিরোধ বা মামলা হতে পারে।
৩. জমি বিক্রি বা হস্তান্তর জটিল হয়ে যায়
যদি খারিজ না করা হয়, তাহলে সেই জমি পরে বিক্রি করতে গেলে নতুন ক্রেতার নাম খারিজ করা যাবে না, কারণ জমি এখনও আপনার নামে নয়, আগের মালিকের নামে।
এতে:
- বিক্রয় রেজিস্ট্রেশন আইনত বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
- ভবিষ্যতে নকল দলিল, প্রতারণা বা জালিয়াতির ঝুঁকি থেকে যায়।
৪. উত্তরাধিকার বা পারিবারিক বিরোধ তৈরি হতে পারে
যদি কোনো জমির খারিজ না করা থাকে এবং আগের মালিক মারা যান, তাহলে সেই জমির উপর উত্তরাধিকার সূত্রে একাধিক দাবিদার তৈরি হতে পারে।
এতে:
- পরিবারের মধ্যে মালিকানা নিয়ে বিরোধ শুরু হতে পারে।
- জমি নিয়ে আদালতে মামলা পর্যন্ত গড়াতে পারে।
৫. সরকারি নথিতে জমির রেকর্ড আপডেট হয় না
খারিজের মাধ্যমে জমির রেকর্ড বা খতিয়ান (RS, SA, CS ইত্যাদি) আপডেট হয়।
যদি খারিজ না করা হয়:
- রেকর্ডে পুরনো মালিকের নাম থেকে যাবে।
- জমি ডিজিটাল রেকর্ড বা নামজারি সিস্টেমে আপনার নামে প্রদর্শিত হবে না।
৬. উন্নয়ন প্রকল্প বা ব্যাংক ঋণে সমস্যা
অনেক সময় জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা স্থাপন, কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে খারিজকৃত দলিল দেখাতে হয়।
খারিজ না থাকলে:
- ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ অনুমোদন করবে না।
- সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে জমি অযোগ্য ঘোষিত হতে পারে।
৭. কর-সম্পর্কিত জটিলতা
খারিজ না করলে জমির মালিকানা পুরনো ব্যক্তির নামে কর নির্ধারিত থাকে।
ফলে:
- আপনার নামে কর প্রদানের প্রমাণ থাকবে না।
- করের হিসাব নিয়ে দ্বৈত মালিকানা বা প্রতারণার অভিযোগ উঠতে পারে।
৮. ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা ও খরচ বৃদ্ধি
খারিজ না করার কারণে জমির রেকর্ড সংশোধন করতে হলে পরে বেশি সময় ও খরচ লাগে।
অনেক ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে নামজারি করতে হয়, যা:
- ব্যয়বহুল,
- সময়সাপেক্ষ,
- এবং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জমি খারিজের মাধ্যমে কী পরিবর্তন হয়?
জমি খারিজের মাধ্যমে-
- মালিকের নাম পরিবর্তন হয়ে নতুন মালিকের নাম যুক্ত হয়।
- নতুন খতিয়ান নম্বর ইস্যু হয়।
- সরকারি রেকর্ড ও ভূমি অফিসের ডাটাবেজে মালিকানা হালনাগাদ হয়।
- মালিক আইনগতভাবে জমির পূর্ণ অধিকার পান।
জমি খারিজের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (Required Documents)
- ক) মূল দলিল (বিক্রয়/হেবা/দান ইত্যাদি)।
- খ) দলিলের সত্যায়িত ফটোকপি।
- গ) পূর্ববর্তী মালিকের খতিয়ান (পর্চা)।
- ঘ) বর্তমান/পূর্ববর্তী ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের দাখিলা।
- ঙ) ওয়ারিশ সনদ (ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত জমির জন্য)।
- চ) আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি।
- ছ) নকশা (প্রয়োজন সাপেক্ষে)।
- জ) কোর্ট ফি এবং অন্যান্য ফি সংক্রান্ত কাগজপত্র।
৬. খারিজের জন্য ফি ও সময় (Fees and Timeframe):
জমি খারিজ করার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট ফি ও সময়সীমা নির্ধারিত আছে, যা জমির অবস্থান, পরিমাণ ও ধরণ অনুযায়ী সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে।
নিচে সাধারণ ধারণাটি দেওয়া হলো-
খারিজের ফি (Fees):
জমি খারিজের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি খুব বেশি নয়। সাধারণত নিচের খাতে টাকা পরিশোধ করতে হয়-
- নামজারি আবেদন ফি: ৫০ টাকা
- নামজারি ফরম (ফর্ম) ফি: ১০ টাকা
- নথি সংরক্ষণ ও প্রসেসিং চার্জ: ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা (জেলা অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে)
- অনলাইন পেমেন্ট চার্জ (যদি অনলাইনে করা হয়): প্রায় ২০–৩০ টাকা
অর্থাৎ মোট খরচ সাধারণত ১৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে সম্পন্ন হয়।
খারিজ সম্পন্নের সময়সীমা (Timeframe):
জমি খারিজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ সময় লাগে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সময় কিছুটা বেশি লাগতে পারে-
- যদি কোনো বিরোধ বা আপত্তি ওঠে,
- নথিপত্র অসম্পূর্ণ থাকে,
- বা ভূমি অফিসে যাচাই-বাছাই বেশি সময় নেয়।
অনলাইন আবেদন করলে আপনি আবেদনের অবস্থা (Application Status) নিয়মিতভাবে নামজারি পোর্টাল থেকে ট্র্যাক করতে পারবেন।


