আপনি কি কখনো জমির কাগজপত্র নিয়ে ধোঁয়াশায় পড়েছেন? খতিয়ান, মৌজা, দাগ নম্বর, জেএল নম্বর – এসব টার্ম শুনলেও বুঝে ওঠা কঠিন? চিন্তার কিছু নেই! আজকের লেখায় আমরা সহজ ভাষায় জানবো এসব পরিভাষার মানে, কীভাবে এগুলো আপনার জমির মালিকানা প্রমাণে সহায়তা করে, এবং কোথা থেকে আপনি এগুলো সংগ্রহ করতে পারেন।
খতিয়ান কী?
খতিয়ান হলো এক ধরনের সরকারি রেকর্ড বা দলিল, যেখানে একটি নির্দিষ্ট জমির মালিকানা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে।
এতে যা থাকে:
জমির মালিকের নাম ও ঠিকানা
জমির পরিমাণ ও শ্রেণি (যেমন: আবাসিক, কৃষি ইত্যাদি)
দাগ নম্বর
অংশ বা হিস্যা (যদি একাধিক মালিক থাকে)
জমির উপর প্রদেয় ভূমি উন্নয়ন কর
সরকারি জরিপের মাধ্যমে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যাতে মালিকানা নির্ধারণ, দখলের স্বত্ব এবং কর আদায় সহজ হয়।
এই খতিয়ানকে “স্বত্বলিপি” বা “Record of Rights (RoR)” নামেও ডাকা হয়।
খতিয়ানের ধরন (বাংলাদেশে প্রচলিত ৪ ধরনের খতিয়ান)
জমির ইতিহাস এবং জরিপের সময় অনুযায়ী বাংলাদেশে চার ধরনের খতিয়ান প্রচলিত:
✅ C.S. খতিয়ান (Cadastral Survey)
সময়কাল: ১৮৮৮ – ১৯৪০ (ব্রিটিশ আমল)
বৈশিষ্ট্য: সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহাসিক রেকর্ড
✅ S.A. খতিয়ান (State Acquisition Survey)
প্রণয়ন: জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর, ১৯৫০-এর দশকে
ভূমিকা: জমি রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণের প্রেক্ষিতে প্রস্তুতকৃত
✅ R.S. খতিয়ান (Revisional Survey)
উদ্দেশ্য: পূর্ববর্তী খতিয়ানের ভুল সংশোধন
অধিক আপডেটেড, কিন্তু নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা প্রয়োজন
✅ B.S. খতিয়ান (Bangladesh Survey)
সময়কাল: স্বাধীনতার পরবর্তীকালে শুরু, এখনও কিছু এলাকায় চলছে
বর্তমান সময়ে অনলাইন খতিয়ানে বেশি দেখা যায়
আপনি যদি জানেন না কোন খতিয়ান আপনার জমির জন্য প্রযোজ্য, তাহলে জমির অবস্থান ও সময়কাল দেখে তা বোঝা যায়।
মৌজা কী?
“মৌজা” বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ইউনিট, যেটি মূলত রাজস্ব সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হয়।
সহজভাবে বললে:
একটি মৌজা মানে এমন একটি এলাকা, যা এক বা একাধিক গ্রাম বা পাড়া নিয়ে গঠিত হতে পারে।
জমির খতিয়ান ও জরিপের সময় মৌজা অনুযায়ী জমি ভাগ করা হয়, এবং প্রতিটি মৌজার আলাদা একটি শনাক্তকারী নম্বর থাকে—এটাই জেএল নম্বর।
জেএল নম্বর কী?
জেএল বা Jurisdiction List Number হচ্ছে প্রতিটি মৌজার জন্য নির্ধারিত একটি ক্রমিক নম্বর, যা জমির কাগজপত্র শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
যেহেতু এক উপজেলায় একাধিক মৌজা থাকতে পারে, তাই জমি চিহ্নিত করতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ:
মৌজার নাম: ধানমন্ডি
জেএল নম্বর: ১২৪
দাগ নম্বর কী?
জমি জরিপের সময় একটি মৌজার ভেতর সমস্ত জমিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা হয়।
এই প্রতিটি ভাগ বা প্লটের একটি করে নম্বর থাকে, যাকে দাগ নম্বর বলা হয়।
একাধিক দাগ নম্বর একত্রে একটি খতিয়ানে থাকতে পারে।
দাগ নম্বর দেখে বোঝা যায়, কোন অংশের জমি কার নামে রয়েছে।
দাগ নম্বর ছাড়া খতিয়ানে জমি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায় না।
♂️ সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)
❓ খতিয়ান কীভাবে সংগ্রহ করবো?
আপনি www.land.gov.bd থেকে অনলাইনেই খতিয়ান দেখতে বা ডাউনলোড করতে পারেন। জেলা ভূমি অফিসেও সরাসরি আবেদন করা যায়।
❓ কোন খতিয়ান বেশি গ্রহণযোগ্য?
C.S. খতিয়ান ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য হলেও, প্রয়োজনে সব খতিয়ান একত্রে যাচাই করতে হয়। বর্তমানে B.S. খতিয়ান অনেক জায়গায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
❓ খতিয়ান আর দলিল কি একই জিনিস?
না, দলিল হলো মালিকানা হস্তান্তরের চুক্তিপত্র; আর খতিয়ান হলো সরকারি রেকর্ড যেখানে মালিকানা স্বীকৃত হয়।
উপসংহার
জমি কেনাবেচা, নামজারি, বা যেকোনো ধরনের জমি-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে খতিয়ান, মৌজা, জেএল নম্বর ও দাগ নম্বর ভালোভাবে বুঝে নেয়া জরুরি।
এই তথ্যগুলো আপনাকে শুধু জমির মালিকানা বোঝাতে সাহায্য করবে না, বরং ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা থেকেও মুক্ত রাখবে।
আপনি যদি নিজের জমির খতিয়ান বা দাগ নম্বর খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে যোগাযোগ করুন বা সরকারি অনলাইন পোর্টাল ব্যবহার করুন।