অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম জানা আজ অত্যন্ত জরুরি, কারণ সরকার এই প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাল করেছে। ভূমি অফিসে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর দিন শেষ; এখন ঘরে বসেই মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।
এই ডিজিটাল দাখিলা আপনার মালিকানার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এই প্রবন্ধে আমরা আপনাকে মাত্র কয়েকটি সহজ ধাপে দেখাবো কিভাবে নিবন্ধন, হোল্ডিং এন্ট্রি এবং পেমেন্টের মাধ্যমে আপনার খাজনা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে পরিশোধ করবেন।
অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া (ধাপে ধাপে)
অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রক্রিয়াটি মূলত দুটি প্রধান ধাপে বিভক্ত:
নাগরিক হিসেবে নিবন্ধন ও প্রোফাইল তৈরি।
জমির খতিয়ান হোল্ডিং হিসেবে যুক্তকরণ ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ।
ধাপ ১: নাগরিক হিসেবে নিবন্ধন ও প্রোফাইল তৈরি
অনলাইনে খাজনা দেওয়ার জন্য প্রথমে ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেমে (Land Development Tax System) আপনার একটি অ্যাকাউন্ট বা প্রোফাইল তৈরি করতে হবে।
১.১. ওয়েবসাইট বা অ্যাপে প্রবেশ
আপনার মোবাইল বা কম্পিউটারের ব্রাউজারে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট-এ (বর্তমানে www.land.gov.bd অথবা সরাসরি https://ldtax.gov.bd/) প্রবেশ করুন।
ওয়েবসাইটটিতে গিয়ে “ভূমি উন্নয়ন কর” সেবার অপশনে ক্লিক করুন।
১.২. নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু
“ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান” অপশনে ক্লিক করার পর “নিবন্ধন করুন” বাটনে ক্লিক করুন।
প্রদত্ত ফর্মে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্মতারিখ (এনআইডি অনুযায়ী) এবং সচল মোবাইল নম্বর প্রদান করুন।
একটি ক্যাপচা (নিরাপত্তা কোড) পূরণ করে “পরবর্তী পদক্ষেপ” বাটনে ক্লিক করুন।
১.৩. OTP যাচাই ও পাসওয়ার্ড সেট
আপনার দেওয়া মোবাইল নম্বরে একটি ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (OTP) আসবে।
প্রাপ্ত OTP টি নির্দিষ্ট বক্সে ইনপুট করে “যাচাই করুন” বাটনে ক্লিক করুন।
যাচাই সফল হলে, আপনাকে একটি পাসওয়ার্ড সেট করার অপশন দেওয়া হবে। আপনার প্রোফাইলের নিরাপত্তার জন্য একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করুন এবং তা মনে রাখুন।
সফলভাবে পাসওয়ার্ড সেট করার পর আপনার নাগরিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: আপনি যদি ইতোমধ্যে নিবন্ধন করে থাকেন, তবে শুধু আপনার মোবাইল নম্বর এবং সেট করা পাসওয়ার্ড দিয়ে “লগইন” করুন। যদি পাসওয়ার্ড ভুলে যান, তাহলে “আপনি কি পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?” অপশন ব্যবহার করে তা রিসেট করতে পারবেন।
ধাপ ২: জমির খতিয়ান হোল্ডিং হিসেবে যুক্তকরণ ও কর পরিশোধ
নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর এবার আপনার জমির তথ্য সিস্টেমে যুক্ত করতে হবে এবং খাজনা পরিশোধ করতে হবে।
২.১. লগইন এবং ‘হোল্ডিং এন্ট্রি’
আপনার মোবাইল নম্বর এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সিস্টেমে লগইন করুন।
ড্যাশবোর্ডে প্রবেশ করে “ভূমি উন্নয়ন কর” অপশন থেকে “নতুন হোল্ডিং এন্ট্রি” বা “খতিয়ান যুক্ত করুন” বাটনে ক্লিক করুন।
২.২. জমির অবস্থান ও তথ্যাদি প্রদান
একটি নতুন ফর্ম আসবে। সেখানে আপনার জমির বিভাগ, জেলা, উপজেলা, এবং মৌজা সঠিকভাবে নির্বাচন করুন।
এরপর আপনার জমির খতিয়ান নম্বর এবং দাগ নম্বর ইনপুট করুন। (মনে রাখবেন, একটি খতিয়ানের জন্য একাধিক দাগ থাকতে পারে)।
সঠিক তথ্য দেওয়ার পর “অনুসন্ধান” বাটনে ক্লিক করুন।
যদি আপনার জমির খতিয়ানটি সিস্টেমে থাকে, তবে খতিয়ানের বিস্তারিত তথ্য স্ক্রিনে প্রদর্শিত হবে।
প্রদর্শিত তথ্যাদি ভালোভাবে যাচাই করুন। যদি সব তথ্য সঠিক থাকে, তবে “হোল্ডিং এন্ট্রি সম্পন্ন করুন” বা অনুরূপ বাটনে ক্লিক করুন।
২.৩. হোল্ডিং-এর সমন্বয় (ভূমি অফিসের কাজ)
একবার আপনি হোল্ডিং এন্ট্রি সম্পন্ন করলে, সেই তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে (উপজেলা/ইউনিয়ন ভূমি অফিস) যাচাই-বাছাই ও অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ থাকবে।
ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা আপনার দেওয়া তথ্য, খতিয়ানের কপি, নামজারির (মিউটেশন) কাগজপত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করে আপনার হোল্ডিংটি অনুমোদন (সমন্বয়) করবেন।
এই সমন্বয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আপনার প্রোফাইলের “হোল্ডিং ট্র্যাকিং” বা “হোল্ডিং” সেকশনে আপনার জমির হোল্ডিং নম্বর এবং ধার্যকৃত বকেয়া ও হাল সনের ভূমি উন্নয়ন করের পরিমাণ দেখা যাবে।
দ্রষ্টব্য: অনেক সময় ভূমি অফিসে ম্যানুয়াল নথি থেকে ডিজিটাল সিস্টেমে তথ্য সমন্বয়ে সময় লাগতে পারে। যদি দেখেন দীর্ঘদিনেও হোল্ডিং সমন্বয় হচ্ছে না, তাহলে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে যোগাযোগ করে আপনার আবেদনটির বিষয়ে অবহিত করুন।
২.৪. অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ
হোল্ডিং সমন্বয়ের পর আপনার প্রোফাইলে প্রবেশ করে, যে হোল্ডিংটির খাজনা পরিশোধ করতে চান, সেটি নির্বাচন করুন।
এবার “অনলাইন পেমেন্ট” বা “কর পরিশোধ করুন” বাটনে ক্লিক করুন।
প্রদত্ত অপশন থেকে আপনার পেমেন্ট মাধ্যম নির্বাচন করুন (যেমন: ই-চালান, সোনালী পেমেন্ট গেটওয়ে বা সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং)।
পেমেন্ট মেথড হিসেবে আপনি মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ, রকেট, ইত্যাদি), ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, বা অনলাইন ব্যাংকিং বেছে নিতে পারেন।
২.৫. পেমেন্ট সম্পন্ন করা
আপনি যদি মোবাইল ব্যাংকিং নির্বাচন করেন, তবে আপনার মোবাইল নম্বর এবং ওটিপি দিয়ে পেমেন্টটি নিশ্চিত করুন।
যদি কার্ড বা অনলাইন ব্যাংকিং নির্বাচন করেন, তবে কার্ডের তথ্য (কার্ড নম্বর, মেয়াদ, CVV) দিয়ে পেমেন্টটি সম্পন্ন করুন।
সফল পেমেন্ট সম্পন্ন হলে, আপনার মোবাইলে একটি নিশ্চিতকরণ বার্তা আসবে।
ধাপ ৩: দাখিলা রশিদ (Digital Dakhila) সংগ্রহ
পেমেন্ট সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্রাউজারে ডিজিটাল দাখিলা বা রসিদ প্রদর্শিত হবে।
এটিই হলো আপনার ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের চূড়ান্ত প্রমাণ।
অবিলম্বে দাখিলাটি ডাউনলোড করুন এবং সম্ভব হলে প্রিন্ট করে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করুন। এই দাখিলাতেই আপনার হোল্ডিং নম্বর, পরিশোধিত করের পরিমাণ, পরিশোধের তারিখ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ থাকে।
অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর কেন পরিশোধ করবেন?
ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইন ভূমি সেবার সুবিধাগুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক:
সময় সাশ্রয়: ভূমি অফিসে সশরীরে না গিয়ে, যেকোনো স্থান থেকে সুবিধামত সময়ে খাজনা পরিশোধ করা যায়।
স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা: অনলাইন সিস্টেমে করের হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়, ফলে ভুল হওয়ার সুযোগ কম।
২৪/৭ সুবিধা: দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহের ৭ দিনই সেবাটি গ্রহণ করা যায়।
ডিজিটাল দাখিলা: পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গেই ডিজিটাল দাখিলা (রসিদ) পাওয়া যায়, যা সংরক্ষণ করা সহজ।
নগদবিহীন (Cashless) ব্যবস্থা: সরকারি নির্দেশনায় বর্তমানে অনলাইনে পরিশোধই একমাত্র বাধ্যতামূলক উপায়।
অনলাইনে জমির খাজনা দিতে কি কি প্রয়োজন?
অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের জন্য আপনার কয়েকটি প্রাথমিক তথ্য ও উপকরণ প্রয়োজন হবে:
জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) নম্বর: জমির মালিকের অবশ্যই একটি সচল এনআইডি নম্বর থাকতে হবে।
সচল মোবাইল নম্বর: নিবন্ধন ও ওটিপি (OTP) বা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড পাওয়ার জন্য এটি আবশ্যক।
জন্মতারিখ: এনআইডি অনুযায়ী জন্মতারিখ।
জমির তথ্য: জমির খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং মৌজার নাম।
পূর্বের দাখিলা (যদি থাকে): জমিটি পূর্বে খারিজ (নামজারি) করা থাকলে বা খাজনা দেওয়া থাকলে সে সংক্রান্ত তথ্য।
ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিভাইস: একটি কম্পিউটার বা স্মার্টফোন এবং স্থিতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ।
পেমেন্টের মাধ্যম: মোবাইল ব্যাংকিং (যেমন- বিকাশ, নগদ, রকেট) বা ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ও সতর্কতা
খাজনা বকেয়া: ভূমি উন্নয়ন কর যদি তিন বছরের বেশি বকেয়া থাকে, তবে সরকার আইন অনুযায়ী আপনার জমি বাজেয়াপ্ত বা খাস করার ক্ষমতা রাখে। তাই সময়মতো খাজনা পরিশোধ করা অত্যাবশ্যক।
অগ্রিম পরিশোধ: ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, আপনি সর্বোচ্চ তিন বছরের অগ্রিম ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পারবেন।
আপত্তি দাখিল: হোল্ডিং ট্র্যাকিং করার পর যদি আপনার ধার্যকৃত করের পরিমাণ বা অন্য কোনো তথ্যে আপত্তি থাকে, তাহলে “আপত্তি দাখিল” অপশন ব্যবহার করে তা ভূমি অফিসকে জানাতে পারবেন।
হটলাইন: অনলাইনে যেকোনো ধরনের সমস্যা হলে বা সহায়তার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৬১২২ অথবা ৩৩৩ নম্বরে কল করতে পারেন।
ওয়ারিশ সূত্রে জমি: ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত জমির খাজনা পরিশোধের ক্ষেত্রে ওয়ারিশ সনদ বাধ্যতামূলক। মালিকের বৈধ ওয়ারিশ হিসেবে শনাক্ত হতে এটি প্রয়োজন।
এনআইডি আপডেট: যদি আপনার এনআইডি সংশোধন করা হয়ে থাকে, তবে নাগরিক প্রোফাইলে গিয়ে “এন.আই.ডি আপডেট” বাটনে ক্লিক করে তথ্য হালনাগাদ করে নিতে হবে।
উপসংহার
অনলাইনে জমির খাজনা দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে, দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে নাগরিকরা ঝামেলা ছাড়াই তাদের ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে ডিজিটাল দাখিলা সংগ্রহ করতে পারছেন। এটি একদিকে যেমন সরকারি সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছে, তেমনি দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রিতা কমাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। আপনিও আর দেরি না করে আপনার জমির বকেয়া ও হাল সনের খাজনা দ্রুত অনলাইনে পরিশোধ করে নিন।


